আকাশ পার হয়ে গেল
আফসানা বেগম তার ছয় বছর বয়সী শিশুকন্যাকে নিয়ে রেললাইনের পাশে, ছোট্ট
ঝুপড়িতে বসে আছেন। উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। ওদিকে আকাশ দেখা
যায়। তিনি ভাবলেন,
“আকাশটা এত্ত বড় হয়ে কি লাভ? সে তো মানুষের মাঝে তার বিশালতা ছড়িয়ে দিতে পারছে না।”
মাঝে মাঝে আফসানা বেগমের চিন্তার মধ্যে দার্শনিক ভাব চলে আসে। এখনও হয়তো চলে এসেছে। তাই সে আকাশ নিয়ে ভাবছেন।
আফসানা বেগম গত তিনদিন ধরে ঝুপড়ির মধ্যেই আছেন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার মেয়ে জিজ্ঞেস করে,
“মা আইজ কি কামে যাবা না?”
আফসানা বেগম কোন উত্তর দেন না। কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে নেই। এই প্রশ্নটাও
ঠিক এমনই। তিনি তার মেয়েকে কি করে বুঝাবেন যে, “তার চাকরীটা আর নেই!”
সামিয়া তার মায়ের পাশে বসে আছে। তার একটা অভ্যাস হলো- “মা যা করবে সে তাই
করবে।” মা এখন আকাশ দেখছে তাই সেও এখন আকাশ দেখছে। সামিয়া আকাশের দিকে শুধু
তাকিয়ে থাকে কিন্তু কোন কিছু ভাবে না। তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু
অনেকগুলো প্রশ্ন- “মা’র কি কাজ কাম নাই? আগে তো সকাল বেলা বের হতো আর রাতে
ফিরতো। এখন আর যায় না কেন? সারাদিন কেন বসে থাকে? কেন সবসময় তার চোখ বেয়ে
জল গড়িয়ে পরে?”
সামিয়া মনে মনে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। সে আকাশের কাছে প্রশ্ন করে, ” আমার মা কাঁদে কেন?”
আকাশ কোন জবাব দেয় না। আকাশের এই নিরবতা সামিয়ার ভালোই লাগে। প্রশ্নের
উত্তরে খারাপ কিছু বলার চেয়ে নিরবতাই ভাল। মাস খানেক আগে নুরুল চাচাকে
জিজ্ঞেস করেছিলো- “আমার মা কী করে?”
নুরুল চাচা জবাব দিয়েছিলেন- ” তোর মা বেশ্যাগিরি করে।”
উত্তরটা সামিয়ার ভালো লাগেনি। তাই সে আর কাউকে প্রশ্ন করে না। আশেপাশের
মানুষগুলোকে তার বড্ড ঘৃণা। এর চেয়ে আকাশ ভাল, এর চেয়ে গাছ ভাল, এর চেয়ে
নদী ভাল। এরা নিরবতা অবলম্বন করে। উপকার করতে পারুক কিংবা না-ই পারুক তারা
ক্ষতি করে না। অথচ মানুষগুলি উপকার না করলেও ক্ষতি করতে সিদ্ধহস্ত।
আফসানা বেগম তার মেয়ের পিঠে হাত বুলালেন। ফ্রকটার পেছনদিকে, বড় ছেড়াটা
হাতের ছোঁয়ায় আটকে গেল। আফসানা বেগম মনে মনে ভাবলেন, “নাহ্, এবার ওকে একটা
সুন্দর লাল টুকটুকে জামা কিনে দিতে হবে।” ঘাড়ে হাত বুলাতে গিয়ে আফসানা বেগম
লক্ষ্য করলেন সামিয়ার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই একজন মা
হিসেবে তার চিন্তিত হওয়ার কথা। কিন্তু আফসানা বেগম তেমন বিচলিত হলেন না।
তিনি জানেন যে, “তাদের চিকিৎসা করার মতো কেউ নেই।”
তাই অসুখ আসুক অথবা সুখ আসুক! সবকিছু নিজেদের মাঝেই ভাগ করে নিতে হয়।
মা-মেয়ে দুজনে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কেউ কোন কথা বললেন
না। সামিয়ার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে অথচ তার মা শুরু না করলে সে কিভাবে
করবে? তার আর এভাবে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না। সে তার মা কে জিজ্ঞেস করলো,
— মা… মা…, আকাশ এত্তো বড় কেন?
— যাতে কেউ সহজেই আকাশ পাড়ি দিতে না পারে।
— আকাশের ওইপাশে কি আছে?
— জানি না।
— মা আমরা ভাত খাই না কেন?
— ঘরে চাল নাই তাই।
— তাহলে আমরা আলুভর্তা খাচ্ছি না কেন?
— আলুও নাই।
সামিয়া আর কিছুই বলতে পারছে না। তার পেটের মধ্যে গুমরে উঠছে ব্যাথাগুলি।
কাদামাটির ফাঁক গলে বাতাস যেভাবে বুদবুদ করে গুলিয়ে ওঠে তার পেটটাও তেমন
করে গুলে ওঠে। নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসতে চায়। মাথা ঘুরঘুর করে। চোখে ঝাপসা
দেখে। অথচ, আকাশের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ। সে আবার তার মাকে জিজ্ঞেস করে,
— মা, আকাশের ওপারে যারা থাকে তাদের কি ক্ষুধা লাগে না?
— না, লাগে না।
— আমি তাহলে আকাশের ওপারে যাব।
— আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবি?
— নাহ্ পারবো না। তাই তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো।
আফসানা বেগম তার মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটা হাসছে। বয়স কম হলেও মেয়েটার অনেক বুদ্ধি। একদম বাবার মতো হয়েছে। আচ্ছা, রায়হানের কি এতো দ্রুত চলে যাওয়ার খুব দরকার ছিলো? যখন সে তারার দেশের অধিবাসী তখন তার ২৫ তম জন্মদিনের কেকটা ফ্রিজে ঠান্ডায় কাঁপছিল। অথচ কেকটার গায়ে যার ছুরি চালানোর কথা সে আর চালালো না। এভাবেই বোধহয় প্রাণগুলি হঠাৎ করেই তারা হয়ে যায়। রেখে যায় স্মৃতিগুলি আর হয়ে যায় অতীত।
আকাশে আজ অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে। সামিয়া আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে
আছে। আফসানা বেগম পাশে বসে একটা আধখাওয়া বনরুটি চিবুচ্ছেন। সামিয়া বললো,
— মা, চাঁদ কি আমার মামা হয়?
— হু
— চাঁদমামা দেখতে রুটির মতো তাই না?
— হু
— সব মামারা কি দেখতে রুটির মতো হয়?
— না, সব মামারা দেখতে রুটির মতো হয় না। শুধু চাঁদ মামারাই দেখতে রুটির মতো হয়।
— চাঁদ মামা কি জানে, আমার প্রচুর রুটি খেতে ইচ্ছে করে?
— হুম জানে।
— তাহলে আমাকে রুটি বিলায় না কেন?
— বিলানোর নিয়ম নেই। যে জোছনা বিলায় সে রুটি বিলায় না।
চাঁদটাকে খপ করে ধরে এনে কামড়িয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। সামিয়া আকাশের দিকে
হাত বাড়াল। তার হাতটা আকাশ ছুলো কি না বলতে পারবো না। তবে সে যে আকাশ
পেরিয়ে অনেকদূরে চলে গেছে সেটা বলা যায়। চাঁদ মামা হাসছে…. এতো জোরে শব্দ
করে কেউ হাসে? আফসানা বেগমও হাসছেন। চাঁদের সাথে একসাথে মিলে প্রবল
হাসাহাসি করছেন। তাদের হাসি উর্ধ্বাকাশ ছাড়িয়ে রায়হানের কানে এসে বাজে।
তিনি তার কোলে থাকা মেয়েকে কানে কানে বলেন,
“তোমার মা পাগল হয়ে গেছে”
সামিয়া বললো, “না বাবা, পাগল হয়নি। পাগলী হয়েছে।”
রায়হান শব্দ করে হাসলেন। তার মেয়েটা তার মতোই হয়েছে। ইঁদুরের মতো দাঁতগুলি দেখলে আর কথাগুলি শুনলে সেটাই আন্দাজ হয়।
Comments
Post a Comment